হজ্ব ও হতে পারে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায়

0
514

আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ বিন বায

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য এবং আখেরাতের শুভ পরিণতি মুত্তাকীদের জন্য। আর দরুদ ও সালাম (রহমত ও শান্তি) বর্ষিত হউক আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসূল, তাঁর বন্ধু, তাঁর ওহীর হেফাযতকারী, তাঁর সৃষ্টি সংক্রান্ত গুণাবলীর গুণকীর্তনকারী, আমাদের নবী, আমাদের ইমাম ও সরদার মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহর উপর; যিনি আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীদের ইমাম (নেতা)। আর রাসূলের পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথী এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা যথাযথভাবে তাঁর অনুসারী হবে তাদের প্রতিও শান্তি বর্ষিত হোক।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার যাবতীয় নি‘আমতের জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে ও বায়তুল হারামে হজ্জব্রত পালনকারী সবাইকে এবং সমস্ত মুসলমানকে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের এবং তাদের অবস্থা পরিশুদ্ধ করার তাওফীক দেন। তিনি যেন তাদেরকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন এবং তাদের মধ্যকার উত্তম ব্যক্তিরা যেন তাদের অভিভাবক বা বন্ধু হয়। যাতে সে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য করতে পারে এবং তাঁর কালিমাকে বুলন্দ (সুউচ্চ) করতে পারে। আর আল্লাহই এ ব্যাপারে ওয়ালী তথা অভিভাবক এবং ক্ষমতাবান।

হে বায়তুল হারামে হজ্জব্রত পালনকারী দ্বীনী ভ্রাতৃমণ্ডলী! ইসলামের অনেক বড় লক্ষ্য এবং বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য রয়েছে। তাতে তাৎক্ষণিক ও বিলম্বিত উপকারিতা রয়েছে, রয়েছে ইহকালীন ও পরকালীন ফায়দা। যেমন সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্জ প্রভৃতি। আল্লাহর প্রতিটি বিধানে বান্দার জন্য বড় কল্যাণ ও বহু উপকারিতা রয়েছে দুনিয়ার তাৎক্ষণিক কর্মে। তন্মধ্যে আন্তরিক পরিশুদ্ধি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিস্থিতি সুদৃঢ় হওয়া, পবিত্র জীবিকা ও আন্তরিক প্রশান্তি ইত্যাদি।

এছাড়া এতে রয়েছে প্রশংসিত পরিণতি, জান্নাতে আল্লাহর দীদার (দর্শন) লাভের মাধ্যমে বিরাট সফলতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে কৃতকার্য হওয়া। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِيْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيْقٍ، لِيَشْهَدُوْا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوْا اسْمَ اللهِ فِيْ أَيَّامٍ مَعْلُوْمَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيْمَةِ الْأَنْعَامِ

‘আর তুমি মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা প্রচার করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সকল প্রকার (পথশ্রান্ত) কৃশকায় উটের উপর সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হতে। যাতে তারা তাদের (দুনিয়া ও আখেরাতের) কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হতে পারে এবং রিযিক হিসাবে তাদের দেওয়া গবাদিপশুসমূহ যবেহ করার সময় নির্দিষ্ট দিনগুলিতে তাদের উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।’ (সূরা হজ্জ ২২/২৭-২৮)

হজ্জের বৈধতা বা শার‘ঈ ভিত্তি

হজ্জ একটি বিরাট বার্ষিক ইবাদত, যা আল্লাহ বান্দার জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন। কেননা তাতে রয়েছে অনেক বড় উপকারিতা, বড় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ। এটা পৃথিবীর সকল এলাকার প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীর উপর ফরয, যদি তারা এটা পালনে (আর্থিক ও শারীরিক দিক দিয়ে) সামর্থ্য রাখে। যেমন আল্লাহ বলেছেন,

وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيْلاً

‘আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ্জ করা ঐ ব্যক্তির উপর ফরয করা হলো, যার এখানে আসার সামর্থ্য রয়েছে।’ (আলে ইমরান ৩/৯৭)

বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনু উমার হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ وَإِقَامِ الصَّلاَةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَحَجِّ الْبَيْتِ وَصَوْمِ رَمَضَانَ

‘ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দেওয়া এ মর্মে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল, ছালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, বাইতুল্লাহর হজ্জ করা এবং রামাযানের ছাওম পালন করা’।[১] এই পাঁচটি স্তম্ভ হচ্ছে ইসলামের রুকন। এগুলো তাঁর খুঁটি, যার উপরে ইসলামের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত।

এটা হিজরী নবম বা দশম সনে ফরয হয়েছে। সহীহ মুসলিমে উমার (রা.) হতে বর্ণিত, জিবরীল (আ.)-এর ঈমান ও ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন সম্বলিত হাদীছে আছে, রাসূল (সা.) তাঁকে বলেন,

الإِسْلاَمُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ وَتُقِيمَ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِىَ الزَّكَاةَ وَتَصُومَ رَمَضَانَ وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلاً

‘ইসলাম হলো আপনার একথার সাক্ষ্য দান যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রাসূল। আর ছালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রামাযানের ছাওম পালন করা এবং বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) পর্যন্ত পেঁŠছার সামর্থ্য থাকলে হজ্জব্রত পালন করা’।[২]

সহীহাইন বুখারী ও মুসলিমে এসেছে— আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন,

مَنْ أَتَى هَذَا الْبَيْتَ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَمَا وَلَدَتْهُ أُمُّهُ

‘যে ব্যক্তি এই ঘরের নিকটে আসল, অতঃপর কোন অনর্থক ও অশ্লীল কাজ করল না, সে ঐদিনের মত নিষ্পাপ হয়ে প্রত্যাবর্তন করে যেদিন তার মা তাকে নিষ্কলুষভাবে প্রসব করেছিল।’[৩] এটা হজ্জ ও উমরা উভয়কেই শামিল করে।

সহীহাইনে আরো আছে, আবু হুরাইরা (রা.) নবী করীম (সা.) হতে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (সা.) বলেছেন, الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا، وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ ‘উমরা হলো এক উমরা হতে অন্য উমরা পর্যন্ত সংঘটিত সকল পাপের কাকফারা। আর কবুল হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত অন্য কিছু নয়।’ [৪] এটাই হজ্জ ও উমরার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। সুতরাং যে ব্যক্তি শরী‘আত সম্মত উপায়ে তা আদায় করবে তার প্রতিদান হলো জান্নাত, সম্মান, গোনাহ থেকে মুক্তি এবং পাপসমূহ মোচন। এ উদ্দেশ্য ছাড়াও তার রয়েছে বিরাট কল্যাণ এবং অতি বড় মর্যাদা।

যে ব্যক্তি দূর বা কাছ থেকে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ ঘরের কাছে আসবে এবং কোন অনর্থক ও অশ্লীল কাজ না করে উত্তম উপায়ে হজ্জ সমাপন করবে, আল্লাহ তার বিনিময় তার জন্য জান্নাত ও গোনাহ থেকে মুক্তিকে অবধারিত করে দিবেন। উমরাও ঠিক অনুরূপ। যেহেতু মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ ঘরের নিকটে আসবে’ এবং যেহেতু তিনি বলেছেন, ‘উমরা হলো দুই উমরার মধ্যবর্তী সমস্ত গোনাহর কাফফারা স্বরূপ।’

এই মহান উদ্দেশ্য প্রত্যেকের, যারা এই বরকতময় শহরে পৌঁছার ইচ্ছা করে। আর প্রত্যেক মুমিন নারী-পুরুষের পার্থিত বিষয় হচ্ছে জান্নাত লাভ, জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ, গোনাহ থেকে মুক্তি এবং সমস্ত পাপ মোচন হওয়ার মাধ্যমে কৃতকার্য হওয়া। আল্লাহ তাঁর প্রিয় দোস্ত ইবরাহীম (আ.) সম্পর্কে খবর দিয়েছেন যে, তিনি এই শহরবাসীর জন্য দো‘আ করেছেন। আল্লাহ তাঁর বন্ধু ইবরাহীমের ভাষায় এভাবে উল্লেখ করেছেন,

رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ

‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকটে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াত সমূহ পাঠ করবেন, তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দিবেন এবং তাদের (অন্তরসমূহকে) পরিচ্ছন্ন করবেন। নিশ্চয়ই আপনি মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা বাকারাহ ২/১২৯)

আল্লাহ এই দু‘আ কবুল করলেন। অতঃপর তাঁর প্রিয় বন্ধু মুহাম্মাদ (সা.)-কে ইবরাহীম (আ.) বর্ণিত বিষয়সমূহ সহকারে প্রেরণ করলেন। আর তিনি আল্লাহ কর্তৃক অবতারিত কিতাব তাদেরকে (মানুষকে) পাঠ করে শোনান এবং তাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব। অর্থাৎ কুরআন এবং হেকমাত অর্থাৎ সুন্নাহ। আর তাদেরকে আল্লাহ প্রেরিত মহান চরিত্র ও বিভিন্ন প্রকার সুউচ্চ ইবাদতসমূহ দ্বারা পরিশুদ্ধ করেন এবং দুশ্চরিত্র ও গর্হিত গুণাবলী হতে তাদেরকে পবিত্র করেন। সুতরাং ইসলাম হলো তাদের জন্য পবিত্রকারী এবং সকল মন্দ কাজ, খারাপ ও বিকৃত, ভ্রান্ত চরিত্রের পরিশুদ্ধকারী এবং তাদেরকে উত্তম কাজ ও পবিত্র চরিত্রের দিকে নির্দেশনা দানকারী। তার মধ্যে হজ্জও একটি।

আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সা.) ও সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরামকে এমন জিনিস সহকারে প্রেরণ করেছেন যাতে রয়েছে আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক পবিত্রতা ও উহার পরিশুদ্ধি। তন্মধ্যে যাকাত, পবিত্রতা ও ছালাত প্রতিষ্ঠা আল্লাহ যেমন বিধিবদ্ধ করেছেন, তেমনি রামাযানের সাওম পালন করা ও বাইতুল্লাহর হজ্জ করাও আল্লাহ ফরয করেছেন। অনুরূপভাবে অবশিষ্ট আদেশসমূহ পালন করা এবং নিষেধ সমূহ পরিহার করাও আল্লাহ প্রদত্ত শরী‘আতের অন্তর্গত। সুতরাং সমস্ত রাসূল (আ.), তাঁদের মাথার মুকুট এবং তাঁদের মধ্যে শেষ ও তাঁদের নেতা আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সা.) এজন্য প্রেরিত হয়েছিলেন, যাতে তারা মানুষকে দুষ্ট চরিত্র, বদ অভ্যাস ও খারাপ প্রকৃতি এবং মন্দ কার্যাবলী থেকে পবিত্র করতে পারেন। আর যাতে তাঁরা উত্তম আমল ও সম্মানিত চরিত্র বা নৈতিকতা দ্বারা মানুষকে পরিশুদ্ধ করতে পারেন। যেগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ ও সর্বোচ্চ হলো আল্লাহর একত্ব, সর্বাবস্থায় ইবাদতকে শুধু তাঁর জন্যই খাস করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা পরিহার করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং ঐসকল জিনিসের প্রতি ঈমান আনয়ন করা যা সংঘটিত  হয়েছে বা হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে খবর দিয়েছেন। তাঁর নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনা এবং তার দ্বীনের উপরে অটল-অবিচল থাকা। এটাই এ ধর্মের মূল এবং তার ভিত্তি।

আল্লাহর একত্ব এবং তাঁর জন্য একনিষ্ঠ হওয়া হজ্জের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এতে বান্দা আল্লাহর জন্যই একনিষ্ঠ হয়ে আসে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করে। সাথে সাথে এই বলে নিজেদের উপস্থিতি ঘোষণা করে لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ  ‘আমি তোমার সমীপে উপস্থিত হয়েছি, তোমার কোন অংশীদার নেই।’ [৫]

সে (হজ্জকারী) একমাত্র আল্লাহর জন্যই ইবাদতকে নির্দিষ্ট করতে চায় এবং তার অন্তর ও আমলকে আল্লাহর সমীপে পেশ করার ইচ্ছা পোষণ করে। আর বার বার এই বাক্য উচ্চারণ করে لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ،   ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার খেদমতে হাযির হয়েছি।’ অর্থাৎ আমি তোমার বান্দা, তোমার উপাসনার উপরেই যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত।

আমি তোমার রাসূল (দূত) ও বন্ধু ইবরাহীম (আ.)-এর দ্বীনের উপরে এবং তাঁর দৌহিত্র মুহাম্মাদ-এর দ্বীনের উপরে তোমার আহ্বানে যথার্থ সাড়া দানকারী। আমি তোমার সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করি, আমার সমস্ত আমল তোমার জন্যই নির্দিষ্ট করি এবং সমস্ত কাজে তোমার দিকেই প্রত্যাবর্তিত হই। যেমন সালাত ও হজ্জ ইত্যাদি। আর বাইতুল্লাহর হজ্জব্রত পালনে আগ্রহী ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই দু‘আ পাঠের মাধ্যমে হজ্জ শুরু করে—

لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيكَ لَكَ

‘হে আল্লাহ! আমি তোমার সমীপে উপস্থিত, তোমার কোন শরীক (অংশীদার) নেই, সকল প্রশংসা ও নি‘আমত তোমারই, সমস্ত রাজত্ব তোমারই জন্য, যাতে অন্য কেউ তোমার শরীক নয়।’ [৬]

ইবাদত কেবল এক আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা, তাঁর দিকে মুখ ফিরানো এবং এ স্বীকৃতি প্রদান করা যে, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শরীক নেই সৃষ্টিতে, সমগ্র বিশ্ব পরিচালনায় এবং রাজত্বে। ঐ ব্যাপারে তাঁর তুল্যও কেউ নেই। তাঁরই জন্য সমস্ত ইবাদত, উপাসনা-আরাধনা; অন্যের জন্য নয়।

হজ্জের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে— আল্লাহর জন্য ইবাদত নির্দিষ্ট করা এবং তাঁর দিকে অন্তরকে ফিরানো, এই কথার উপর ঈমান আনয়ন করে যে— তিনিই ইবাদতের হকদার, তিনিই প্রকৃত উপাস্য, তিনি সমস্ত বিশ্বের একচ্ছত্র মালিক বা প্রতিপালক। তিনি সম্মানিত নামসমূহ ও গুণাবলীর অধিকারী, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁর সমতুল্য, সমকক্ষ ও সাদৃশ্য কেউ নেই। এই কথার দিকেই তিনি ইঙ্গিত করে বলেন,

وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيْمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِيْ شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْقَائِمِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ

‘(আর স্মরণ কর) যখন আমরা ইবরাহীমকে বাইতুল্লাহর স্থান নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছিলাম যে, তুমি আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার এ গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, সালাত কায়েমকারীদের জন্য এবং রুকূ-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।’ (হজ্জ ২২/২৬)

সূরা বাকারায় আল্লাহ আরো বলেন,

وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوْا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيْمَ مُصَلًّى وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِىَ لِلطَّائِفِيْنَ وَالْعَاكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ

‘আর যখন আমরা বাইতুল্লাহ (কা‘বা গৃহ)-কে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান হিসাবে নির্ধারণ করলাম (এবং বললাম), তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর স্থানকে সালাতের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর। আর আমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলের কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছিলাম এই মর্মে যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারীদের জন্য, এখানে অবস্থানকারীদের জন্য এবং রুকূকারী ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।’ (বাকারাহ ২/১২৫)

যাতে তারা আল্লাহর সম্মানিত ঘরের নিকটে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে এবং বাইতুল্লাহর আশ-পাশ থেকে সকল মূর্তি, দেব-দেবী, আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধকৃত সমস্ত অপবিত্রতা হতে এবং হজ্জ ও উমরাকারীদেরকে কষ্ট দেয় সে সমস্ত জিনিস হতে এবং যা তাদের উদ্দেশ্য থেকে ফিরিয়ে রাখে সেসব বস্তু হতে যেন বাইতুল্লাহকে পবিত্র করে।

অতএব এ ঘর সালাত আদায়কারী, তাওয়াফকারী এবং ইতেকাফকারীদের জন্য। তারা আল্লাহর ইবাদত করে এ ঘরের নিকটে, তার মধ্যে এবং তার হারাম (নির্ধারিত সীমা)-এর মধ্যে। সুতরাং তাদের জন্য আল্লাহর পথে বাঁধাদানকারী সমস্ত জিনিস থেকে এ ঘরকে পবিত্র করা আবশ্যক। অথবা এ ঘরকে পবিত্র রাখবে ঐসব কথা-কর্ম থেকে যা আগন্তুকদেরকে (ভিন্ন কাজে) ব্যতিব্যস্ত রাখে।

ইবরাহীম (আ.)-এর আহ্বান

অতঃপর আল্লাহ বলেন,

وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوْكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِيْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيْقٍ

‘আর তুমি মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা প্রচার করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সকল প্রকার (পথশ্রান্ত) কৃশকায় উটের উপর সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত হতে।’ (সূরা হজ্জ ২২/২৭-২৮)

ইবরাহীম (আ.) মানুষকে আহ্বান জানান, আর আল্লাহ তাঁর (ইবরাহীমের) আওয়াযকে স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে শুনিয়ে দিয়েছেন। মানুষও ইবরাহীম (আ.)-এর যুগ হতে অদ্যাবধি সেই পবিত্র ডাকে সাড়া দিচ্ছে। এটা শারঈ দলীল দ্বারা প্রমাণিত যে, ইবরাহীম (আ.)-ই প্রথম এ মসজিদকে আবাদ করেছেন এবং তিনিই প্রথম এ ঘরের দিকে মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন। আর তাঁর সম্মান-মর্যাদা মানব মাঝে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ যাকে (বাইতুল্লাহকে) আসমান ও যমীনসমূহ সৃষ্টির দিন থেকে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে হারাম (সম্মানিত) করার কারণে কিয়ামত পর্যন্ত সেটা হারাম (সম্মানিত)-ই থাকবে।

আল্লাহ বলেন,  لِيَشْهَدُوْا مَنَافِعَ لَهُمْ ‘যাতে তারা তাদের (দুনিয়া ও আখেরাতের) কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হতে পারে।’ (সূরা হজ্জ ২২/২৮)

উপকারিতার মহত্ব ও আধিক্যের কারণে আল্লাহ তার কিছু গোপন রেখেছেন এবং কিছু প্রকাশ করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তাৎক্ষণিক ও বিলম্বিত উপকারিতা এবং পার্থিব ও পরকালীন উপকারিতা। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ হলো— আল্লাহর একত্বের স্বীকৃতি এবং বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, তার প্রাঙ্গণে বা সীমানায় সালাত আদায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দাওয়াত দান প্রভৃতি আল্লাহর জন্যই খাস করা। আর আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন করা এবং তাঁর প্রতি বিনয়াবনত হওয়া যাতে তিনি তাদের হজ্জ কবুল করেন, তাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করেন এবং নিরাপদে সুস্থাবস্থায় দেশে ফিরে যাওয়ার তাওফীক দেন। তারা আল্লাহর কাছে মিনতিসহ দু‘আ করবে যেহেতু এই বাইতুল্লাহর কাছে বার বার ফিরে আসতে তাদের প্রতি আল্লাহ দয়া করেছেন।

এটা একটা বড় ফায়দা যে, তারা একমাত্র তাঁরই (আল্লাহর) ইবাদত করবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির মানসেই এখানে আসবে। লোক দেখানো ও জনশ্রুতির জন্য নয় বরং তারা এখানে আসবে শুধু বাইতুল্লাহর তাওয়াফ, তাঁর বড়ত্ব বর্ণনা, তাঁর গৃহের প্রাঙ্গণে সালাত আদায় করা এবং তাঁর অনুগ্রহ চাওয়ার জন্য। এটাই সবচেয়ে বড় উপকারিতা। এর মধ্যে আরো বড় ফায়েদা হলো আল্লাহর তাওহীদ, তাঁর জন্য একনিষ্ঠ হওয়া, তাঁর বান্দাদের মাঝে এর স্বীকৃতি এবং তাঁর আগত বান্দাদের উপদেশ দেওয়া যাতে এই বড় বিষয়টা তারা জানতে ও বুঝতে পারে। আর তারা উঁচ্চ আওয়াযে তালবিয়া পাঠ করবে, যাতে প্রত্যেক লোকে তা শুনতে পায়। এ উদ্দেশ্যেই আল্লাহ উঁচ্চ আওয়াযে তালবিয়া পাঠ ফরয করেছেন, যাতে তারা এর অর্থ জানতে পারে, একে বাস্তবায়িত করে এবং তাদের অন্তর ও যবান দ্বারা একে প্রতিষ্ঠিত করে।

রাসূল বলেন,  أَتَانِىْ جِبْرِيْلُ فَأَمَرَنِىْ أَنْ آمُرَ أَصْحَابِى أَنْ يَرْفَعُوْا أَصْوَاتَهُمْ بِالإِهْلاَلِ

‘আমার নিকট জিবরীল এসে এই আদেশ করলেন যে, আমি যেন আমার ছাহাবীদের উচ্চৈঃস্বরে তালবিয়া পাঠের নির্দেশ দেই।’ [৭]

সুতরাং তালবিয়ার সাথে আওয়ায উচ্চ করাটা সুন্নাত। যাতে কাছের ও দূরের লোকেরা তা জানতে পারে এবং ছোট-বড়, পুরুষ-নারী সবাই তা শিখতে পারে। আর তার প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে পারে এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। আর এর মূল অর্থ হলো ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাদের প্রকৃত উপাস্য, স্রষ্টা, রিযিক দাতা ও মা‘বুদ। এ ইখলাস হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদতেও থাকবে।